হাকিকুল ইসলাম খোকন, যুক্তরাষ্ট্র
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পকে আবারো বিজয় দিতে রাশিয়ানরা কমলা হ্যারিসের বিরুদ্ধে লাগাতার মিথ্যাচারে লিপ্ত হবার চাঞ্চল্যকর তথ্য উদঘাটন করেছে ‘দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট’। রাশিয়ার সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ‘জিআরইউ’র সার্বিক তত্ত্বাবধানে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা এবং ফ্লোরিডার পামবীচ কাউন্টি পুলিশের ডেপুটি চীফ জন মার্ক ডোগানের নেতৃত্বে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট প্রার্থী কমলা হ্যারিসের বিরুদ্ধে নির্জলা মিথ্যাচার চালানো হচ্ছে গত দু’বছরের অধিক সময় যাবত।
উল্লেখ্য, জন মার্ক ফ্লোরিডা থেকে ২০২১ সালে পালিয়ে মস্কোতে গেছেন। ইউরোপিয়ান গোয়েন্দা সংস্থা সরবরাহকৃত দেড় শতাধিক ডক্যুমেন্ট পরীক্ষার পর বৃহস্প্রতিবার ভোরে শীর্ষস্থানীয় আমেরিকার দৈনিক ‘দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট’ রিপোর্টটি প্রকাশ করেছে। ক্রেমলিন প্রশাসন কর্তৃক তথ্য-প্রযুক্তির চরম অপব্যবহার এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পকে মার্কিন ভোটারদের কাছে অধিক জনপ্রিয়তা দেয়ার অভিপ্রায়ে এটি পুতিনের পুরনো খেলার পুনরাবৃত্তি বলেও মন্তব্য করা হচ্ছে।
ওয়াশিংটন পোস্টের পক্ষ থেকে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এমন নির্জলা তথ্য আর আজগুবি প্রচারণার নেপথ্য কাহিনী উদঘাটনে যুক্তরাষ্ট্র কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সহায়তা নিয়েও অভীষ্ঠ্য লক্ষ্যে উপনীত হতে পারেনি। ক্রেমলিনের ঐ ভুয়া প্রচারণার টার্মিনালে কমলার বিরুদ্ধে যা ইচ্ছা তাই উপস্থাপন করা হচ্ছে অবলিলায়। ২০২১ সালের মার্চ থেকে এ বছরের অগাস্ট পর্যন্ত চালানো মিথ্যাচারের ডক্যুমেন্ট পরীক্ষার পর উদঘাটিত হয় পুতিনের বন্ধু ট্রাম্পকে মার্কিনীদের সামনে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে উপস্থাপনের ধারাক্রম।
এদিকে, নির্বাচনের দিনক্ষণ যত এগিয়ে আসছে ততোই ডেমক্র্যাট আর রিপাবলিকান প্রার্থীগণেল প্রচারণা উত্তপ্ত হচ্ছে। বুধবার সন্ধ্যায় সিএনএন’র টাউন হল মিটিংয়ে কমলা হ্যারিস ট্রাম্পকে সরাসরি আক্রমণ করে বলেন, ট্রাম্প হচ্ছেন ফ্যাসিস্ট, গণতন্ত্রের জন্যে মারাত্মক হুমকি। এছাড়া প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনেও অযোগ্য (দৈহিক এবং মানসিক ভাবে)। কমলা-সহ ডেমক্র্যাটিক পার্টির প্রায় সকল শীর্ষ নেতাই এখোন ট্রাম্পের নাম উচ্চারণের আগে ‘ক্রিমিনাল’ শব্দটি ব্যবহারে কালপেক্ষপণ করছেন না। যুক্তরাষ্ট্রে স্মরণকালে আর কোন নির্বাচনেই রাজনৈতিক পক্ষকে এমনভাবে বিষোদগারের উদাহরণ নেই বলে প্রবীণ আমেরিকানরা মন্তব্য করছেন।
গাজায় ইসরায়েলের বর্বরতা এবং নৃশংসতার ব্যাপারে বাইডেন প্রশাসনের আচরণে ক্ষুব্ধ ভোটারদের পক্ষে টানতে কমলা হ্যারিস চষে বেড়াচ্ছেন দোদুল্যমান স্টেট সমূহ। তিনি নির্বাচিত হলে ফিলিস্তিনিদের বহু পুরনো প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটাতে পিছপা হবেন না বলে অঙ্গিকার করছেন। একইসাথে করোনা এবং রাশিয়া কতৃক ইউক্রেনে হামলাজনিত কারণে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ব্যাপরটিকেও আমলে নিয়ে কমলা অঙ্গিকার করছেন যে, স্বল্প ও মাঝারি আয়ের মানুষের এহেন দুর্গতির অবসানে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
নির্বাচনী জরিপে কমলার সাথে ট্রাম্পের হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাসের পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাম্পের অনেক সমর্থক ডেমোক্র্যাট প্রার্থীকে বিজয়ী করার সংকল্প ব্যক্ত করছেন। ট্রাম্প যদি আবারো প্রেসিডেন্ট হতে পারেন তাহলে ‘নিকৃষ্ট স্বৈরাচারী হবেন’ বলে মন্তব্য করেছেন ট্রাম্প আমলে হোয়াইট হাউজের চীফ অব স্টাফ হিসেবে দীর্ঘসময় দায়িত্ব পালনকারি জন কেলি। ইউএস আর্মির চার তারকা বিশিষ্ট এই অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল জেন কেলি মঙ্গলবার নিউইয়র্ক টাইমসকে প্রদত্ত সাক্ষাতকারে হোয়াইট হাউজে মিটিংয়ের সময় ট্রাম্পের বিভিন্ন কথকতার রেকর্ড উপস্থাপনকালে বলেন, জার্মানির জেনারেল এডোল্ফ হিটলার অনেক ভালো কাজও করেছেন বলে দাবি করেন ট্রাম্প। হরহামেশা তিনি নিজেকে হিটলারের মত একজন শাসকে পরিণত করতে চেয়েছেন। তাই ট্রাম্প যদি আবার প্রেসিডেন্ট হতে পারেন তাহলে হোয়াইট হাউজকে স্বৈরাচারে পরিণত করবেন-এতে সন্দেহের অবকাশ থাকতে পারে না। ট্রাম্প হবেন নাজি ডিক্টেটর।
একইভাবে রিপাবলিকান পার্টির অনেক পুরনো সংগঠক এবং উইসকনসিন স্টেটের ঔকেষা সিটির মেয়র শাওন রেইলি (৬৩) জনসমক্ষে কমলা হ্যারিসকে সমর্থন দিয়েছেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মানবিক ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ জাগ্রত রাখতে সামনের নির্বাচনে ট্রাম্পকে পরাজিত করার বিকল্প নেই বলে মন্তব্য করেছেন শাওন রেইলি। উল্লেখ্য, এই সিটি হচ্ছে রিপাবলিকানদের ঘাঁটি। মেয়র কর্তৃক কমলাকে সমর্থন দেয়ার মধ্যে অন্যরকম একটি ইঙ্গিত অনুভব করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা।
২০২১ সালে বাইডেনের শপথ গ্রহনের পরদিন থেকে সীমান্ত অতিক্রম করে গত ৩ বছরে ২২ লাখের অধিক বিদেশী বেআইনীভাবে যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকে পড়ার অবিশ্বাস্য পরিস্থিতি আবারো ঘটবে বলে ট্রাম্প সমর্থক মিডিয়াগুলো লাগাতার প্রচারণা চালাচ্ছে। সর্বশেষ ২৩ অক্টোবর নিউইয়র্ক পোস্ট লিখেছে যে, গুয়াতেমালা থেকে হাজার হাজার মানুষ মিছিল করে মেক্সিকো সীমান্তে জড়ো হচ্ছে। ৫ নভেম্বরের নির্বাচনে কমলা হ্যারিস জয়ী হলেই তারা ঢুকে পড়বেন যুক্তরাষ্ট্রে। উল্লেখ্য, এমন পরিস্থিতির আশংকায় মেক্সিকো সরকার সীমান্ত বরাবর ৩২ হাজার সৈন্য মোতায়েন রেখেছে বলেও শোনা যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে চলমান অভিবাসন সমস্যার ঢেউ আবারো জনজীবনকে অচল করতে পারে বলে রিপাবলিকানরা অভিযোগ করছে। শুধু তাই নয়, ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছেন যে, তিনি বিজয়ী হলে ডেমক্র্যাট অধ্যুষিত সিটিসমূহে সেনাবাহিনী মোতায়েন করবেন অবৈধ অভিবাসী দমনের জন্যে।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আর মাত্র ৮দিন বাকি। জনমত জরিপে জাতীয়ভাবে ট্রাম্পের চেয়ে এগিয়ে থাকলেও ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কারণে হ্যারিসের জনপ্রিয়তায় কিছুটা ভাটার টান তৈরি হচ্ছে, বিভিন্ন জরিপে এমন আভাস পাওয়া যাচ্ছে। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে ভোটারটা নতুন নীতির জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠছেন। দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত পেনসিলভেনিয়ায় প্রচারণাকালে বুধবার কমলা জানিয়েছেন, প্রেসিডেন্ট বাইডেনের চেয়ে তার প্রশাসন আলাদা হবে।
পেনসিলভেনিয়ায় চেষ্টার শহরের টাউন হলের সমাবেশে কমলা বলেন, “আমার প্রশাসনের বাইডেন প্রশাসনের ধারাবাহিকতা হবে না। আমি এই ক্ষেত্রে আমার নিজস্ব ধারণা এবং আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতার প্রয়োগ ঘটাবো। আমি বিভিন্ন বিষয়ে নতুন প্রজন্মের নেতৃত্বের প্রতিনিধিত্ব করি আর আমাদের নতুন দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণ করতে হবে বলে বিশ্বাস করি আমি।”
তবে অঙ্গরাজ্যটির বিভিন্ন স্থানে চালানো প্রচারণার সময় তিনি অধিকাংশ সময়ই বাইডেনের নীতি থেকে কীভাবে এবং কতোটা আলাদা হবেন, এ ধরনের প্রশ্নগুলো এড়িয়ে গেছেন। কাকে ভোট দেবেন যারা এখনও সে সিদ্ধান্ত নেননি, এই ইস্যুটি নিয়ে তাদের মধ্যে কমলার প্রতি সমর্থন কমতে দেখা যাচ্ছে। কমলা তাদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলেও এ ধরনের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে কয়েক শতাংশ ভোটও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।
সিএনএন’র টাউন হলের এ সমাবেশে উপস্থিতদের বেশ কয়েকটি প্রশ্নের জবাবে কমলা হ্যারিস নিত্য পণ্যের উচ্চমূল্য মোকাবেলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ বন্ধ করার সময় এসেছে। তখন তিনি ট্রাম্পকে ‘ফ্যাসিবাদী’ এবং যুক্তরাষ্ট্রের ‘ভবিষ্যৎ ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি’ বলে অভিহিত করেন।
ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকশন ল্যাবের ট্র্যাকিং ডেটা অনুসারে, প্রায় আড়াই কোটি ভোটার ইতিমধ্যে ব্যক্তিগতভাবে আগাম ভোট অথবা মেল-ইন ব্যালটের মাধ্যমে ভোট দিয়েছেন। চলতি সপ্তাহে দোদুল্যমান নর্থ ক্যারোলিনা ও জর্জিয়াসহ বেশ কয়েকটি স্টেটে আগাম ভোট গ্রহণ শুরু হওয়ার প্রথমদিনেই রেকর্ড ভোট পড়েছে। বুধবার রিপাবলিকান প্রার্থী ট্রাম্প আরেক গুরুত্বপূর্ণ দোদুল্যমান স্টেট জর্জিয়ার জেবুলন ও ডুলুথ শহরে প্রচারণা চালিয়েছেন।
৫ নভেম্বরের নির্বাচনে জয়ী হলে ট্রাম্প (৭৮) যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয় ও শেষ মেয়াদে দায়িত্ব পালন করবেন। ট্রাম্প বলেন, “আমরা নয় বছর ধরে নির্বাচনের জন্য লড়ছি। আর এখন মাত্র ১১ দিন হাতে আছে।”
২০১৫ সাল থেকে নির্বাচনের প্রচারণায় নামা ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের টানা তিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান দলের প্রার্থী মনোনীত হয়েছেন। ২০১৬ থেকে ২০২০ পর্যন্ত এক মেয়াদে প্রেসিডেন্ট থাকার পর পরবর্তী নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট বাইডেনের কাছে হেরে যান তিনি। এবারের নির্বাচনে ফের রিপাবলিকান প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এবার তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ডেমোক্র্যাট দলীয় প্রার্থী ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স ও জরিপ সংস্থা ইপসোসের সর্বশেষ জনমত জরিপ অনুযায়ী, জাতীয়ভাবে কমলা সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের চেয়ে ৩ শতাংশ ব্যবধানে এগিয়ে আছেন। কমলার পক্ষে সমর্থন জানিয়েছেন ৪৬ শতাংশ ভোটার আর ট্রাম্পের পক্ষে ৪৩ শতাংশ।